কক্সবাজার, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন: সাগরের বুকে পানি সংকট

আব্দুর রহমান, টেকনাফ::

‘আঁরার চাইরো দাইক্যা পানি, তারপর-অ আরাত্তুন ঘম পানির অভাব। পুরা দ্বীপর মাইনসর জীবন ঘান নুনা পানিত শেষ অই যারগই (আমাদের চারদিকেই পানি তবু খাবার পানির সংকট। পুরো দ্বীপের মানুষের জীবন নোনা পানিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে)’—হতাশার সুরে বলছিলেন সেন্টমার্টিন দ্বীপের ডেইলপাড়ার বাসিন্দা আছিয়া। ৩৫ বছর বয়সী আছিয়া বলেন, ‘আমার বাড়ির নলকূপের পানি বেশি লবণাক্ত। এই পানি ব্যবহার করা কষ্টের। অন্য জায়গা থেকে পানি আনতে প্রায় একঘণ্টা লাগে। এক পাতিল পানি আনতে দুই তিন মাইল হাঁটতে হয়। সেখানেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।’

প্রায় ১০০ থেকে ১২৫ বছর আগে এই দ্বীপে লোকবসতি শুরু হয়। বর্তমানে এখানে ১০ হাজার মানুষের বসবাস। তবে দ্রুতই এ দ্বীপের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে পানিসহ নানা সংকট।

সরেজমিন দেখা যায়, দ্বীপের অনেক জায়গায় গভীর নলকূপ থাকলেও পানিতে আয়রন ও লবণযুক্ত। ফলে খাবার পানির জন্য রীতিমতো হাহাকার চলছে। সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরাও মাইলের পর মাইল রাস্তা পাড়ি দিচ্ছে। অনেকে পুকুর ও লবণযুক্ত পানি পান করতেও বাধ্য হচ্ছেন।

ডেইলপাড়ার আরেক বাসিন্দা সালমা জানালেন, সেখানে তাদের মতো আরও পাঁচশ’ পরিবার রয়েছে। এসব মানুষের জন্য পানির ব্যবস্থা মাত্র একটি মাত্র টিউবওয়েল। কোনাপাড়া ও ছেড়াদিয়া এলাকার চিত্রও একই রকম। বাসিন্দারা জানালেন, তাদের এলাকার টিউবওয়েলের পানিতে লবণ ও আর্সেনিক। নিত্য লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণেও ছড়িয়ে পড়ছে রোগব্যাধি।

দ্বীপের বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন বলেন, দ্বীপের তিন অঞ্চল ডেইলপাড়া, কোনাপাড়া ও ছেড়াদিয়ায় মূলত সুপেয় পানি পাওয়া যেত। কিন্তু কয়েক মাস ধরে এই অঞ্চলগুলোর টিউবওয়েল দিয়ে লবণাক্ত পানি বের হচ্ছে। এছাড়া আগে কূপে পানির পরিমাণও বেশি ছিল। এখন মোটর ছেড়েও ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কয়েক মাস নিজের দায়িত্বে প্রায় ১০০ পরিবারকে সুপেয় পানি বিতরণ করেছি। এখন অবস্থা খুব খারাপ।

পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত দ্বীপের ফ্যান্টাসি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী তোয়াহা মোহাম্মদ জানান, দিনে দিনে পানি কমে যাচ্ছে। পানি জমা হতে ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে।

এদিকে, সেন্টমার্টিনের পানিতে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার ভয়াবহ পরিমাণ উপস্থিতি পেয়েছে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই গবেষণায় জানা যায়, সেন্টমার্টিন সৈকতের পানিতে প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ১ থেকে ২৭২ সিএফইউ ফিকাল কলিফর্ম, অর্থাৎ ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। আর সৈকত থেকে ১ কিলোমিটার দূরে প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বনিম্ন ৩২ থেকে সর্বোচ্চ ২৮০ সিএফইউ ফিকাল কলিফর্ম পাওয়া গেছে। প্রসঙ্গত, সৈকতের ১০০ মিলিলিটার পানিতে ১ থেকে ১০ কলনি ফরমিং ইউনিট (সিএফইউ) ফিকাল কলিফর্মের উপস্থিতি পাওয়া গেলে সেই পানি ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ায় দূষিত ধরা হয়। বছরব্যাপী এই গবেষণায় পর্যটন মৌসুমে অন্য সময়ের তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি দূষণ মিলেছে। সেন্টমার্টিনের চারপাশের সৈকতের মধ্যে জেটি এবং সৈকতের উত্তর ও পশ্চিম মাথায় ফিকাল ও কলিফর্মের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি মিলেছে। সবচেয়ে কম মিলেছে গলাচিপা এলাকায়। সৈকত থেকে ১ কিলোমিটার দূরের ক্ষেত্রে পশ্চিম সৈকত এলাকায় কলিফর্মের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। এসব ব্যাকটেরিয়া জনস্বাস্থ্য ও সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে বলে আশঙ্কা করছেন গবেষকরা।

ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মীর কাশেম বলেন, সেন্টমার্টিনে নির্দিষ্ট কোনও সুয়ারেজ নেই। সমুদ্রে বা মিঠাপানির রিজার্ভারে পাইপ দিয়ে মলমূত্র ছাড়া হয়। পাইপগুলো এক কিলোমিটার পর্যন্ত বসানো হয়েছে। জাহাজগুলোও জেটিতে এসে তাদের সুয়ারেজের মলমূত্র সাগরে ছেড়ে দেয়।

এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, দ্বীপের জনঘনত্ব আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফলে পানির ব্যবহারও বেড়ে গেছে। জীবন ধারণের জন্য যে পরিমাণ পানি দরকার, তা মাথাপিছু অনুযায়ী কমে গেছে।

পানি সমস্যা সমাধানে ভিন্ন উপায়

বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। তবে, এটা শুধু স্বল্প সময়ের জন্য খাবার পানির চাহিদা পূরণ করে। এছাড়া, মিঠা পানির চাহিদা শুধু মানুষের নয়, পরিবেশের প্রতিটি গাছপালা ও জীবজন্তুরও প্রয়োজন। বৃষ্টির পানি ধরে রেখে শুধু মানুষের খাবার পানির চাহিদা মিটতে পারে, কিন্তু পরিবেশের নয়। এর জন্য প্রয়োজন প্রকৃতিনির্ভর সমাধান। তবে এক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ, উৎসের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এদিকে, সি ওয়াটার রিভার্স ওসমোসিস প্ল্যান্ট (এসডব্লিউআরও) অর্থাৎ সমুদ্রের পানি পরিশোধন পদ্ধতি নিয়ে ভাবছেন সেন্টমার্টিনের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ তোয়াহা।

তোয়াহা জানান, এই দ্বীপে পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। কয়েক বছরের মধ্যেই এখানে হাহাকার শুরু হবে। তাই পানির সমস্যা সমাধানে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। নিজ উদ্যোগে আমেরিকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথাও বলেছেন তিনি। সম্ভাব্য ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে দ্বীপে ‘এসডব্লিউআরও’ পদ্ধতির মাধ্যমে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে পারবেন বলে তিনি দাবি করেন।

মূলত এই পদ্ধতিতে দূষিত পানিকে একটি পর্দার একপাশ থেকে আরেক পাশে নিয়ে আসা হয়। ধূলিকণা, লবণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদার্থ ছেঁকে ফেলা হয় পর্দার সাহায্যে। এখন কয়েকটি দেশ দূষিত পানি বিশুদ্ধিকরণে এভাবে কাজ করছে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় সমুদ্রের পানিকে এভাবে সুপেয় করা হচ্ছে। ভারতেও ব্যবহার করা হচ্ছে এ পদ্ধতি।

তোয়াহা মোহাম্মদ বলেন, সাগরের পানি বিশুদ্ধিকরণ শেষে কাচের বোতলে বাজারজাত করা হবে। কারণ, প্লাস্টিকের বোতল পরিবেশবান্ধব নয়।

পাঠকের মতামত: